উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমি খিলাফত
ফাতেমিগণ কর্তৃক উত্তর আফ্রিকা ও মিসরে সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ (Development of Civilization and Culture by the Fatimids in North Africa and Egypt)
ফাতেমি খিলাফতে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয় যা তৎকালীন বিশ্বে বিরল ছিল।
সংস্কৃতিমনা ফাতেমিদের সময় উত্তর আফ্রিকা ও মিসরে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় যে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয় তার কিছু নিদর্শন নিচে তুলে ধরা হলো:
আল আজহার মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয়: খলিফা আল মুইজের সুযোগ্য সেনাপতি জওহর ৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে মিসর জয় করে আল কাহিরা নগরীর গোড়াপত্তন করেন।সেনাপতি সেখানে বিবি ফাতেমাতুজ জোহরার স্মরণার্থে আল আজহার নামে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে খলিফা আল-আজিজ মসজিদে একটি পাঠাগার স্থাপন করেন। এ পাঠাগারই পরবর্তীকালে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়ে বর্তমান বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব লাভ করেছে।
চিত্র: আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় |
উল্লেখ্য, শুরুতে আল আজাহারে কেবল কুরআন ও ইসলামি আইনশাস্ত্রের পাঠ দেওয়া হতো। কালক্রমে এর পাঠক্রমে আরবি ভাষা ও সাহিত্য, ইসলামি জ্যোতির্বিদ্যা, মুসলিম দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এসব বিষয়ে পাঠ দানের জন্য দেশি-বিদেশি বিজ্ঞ পণ্ডিতদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে গণ্য হয়। বস্তুত মুসলিম বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশে এ বিশ্ববিদ্যালয়টির অতুলীয় অবদান রয়েছে।
দারুল হিকমা প্রতিষ্ঠা: ফাতেমি খলিফা আল-হাকিম ১০০৫ খ্রি. কায়রোতে বিখ্যাত দার আল হিকমা বা বিজ্ঞান ভবন নির্মাণ করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরম পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ইতিহাস লাভ করেন। এটি বাগদাদের বায়তুল হিকমার অনুকরণে নির্মিত হয়েছিল। শিয়া ধর্ম বিষয়ে আলোচনা ও গবেষণা ছাড়াও এখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বহু অমূল্য গ্রন্থরাজি সন্নিহিত ছিল। দেশ-বিদেশের বহু প্রখ্যাত পণ্ডিতব্যক্তি তথায় হাজির হতেন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন আলাপ-আলোচনায় অংশগ্রহণ করতেন। এ প্রতিষ্ঠানে কাব্য, সাহিত্য, ব্যাকরণ তুলনামূলক আইন, তর্কশাস্ত্র, আয়ুর্বেদ, জ্যোতির্বিজ্ঞান শব্দ বিজ্ঞান প্রভৃতি চর্চা করা হতো। কুরআন-হাদিস, ফিকাহ ও প্রকৃত বিজ্ঞান অধ্যয়নের জন্য স্বতন্ত্র অধ্যাপক নিয়োজিত ছিলেন। দারুল হিকমার সাথে একটি বিশাল গ্রন্থাগার যুক্ত ছিল। এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের স্বতন্ত্র ড্রেস কোড ছিল। খলিফা আল-হাকিম এ প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা ও উন্নয়নের জন্য তৎকালের বিখ্যাত দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক ইবনে হায়সামকে এর তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করে।
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি প্রথম পত্র
বিখ্যাত পণ্ডিতঃ ফাতেমিদের পৃষ্ঠপোষকতায় উকিৎসা বিজ্ঞান ও প্রাকৃতিক বিদ্যাচর্চায় বিশেষ অবদান রাখেন ইহুদি মুসা বিন আল সাজ্জান এবং তদীয় পুত্রদ্বয় ইসহাত ও ইসমাঈল) সাঈদ বিন বাতরিত (ইরি), ঐতিহাসিক হল তিন্দি, সাহিত্যিক ও কবি ইবনে মাল্লাস এবং দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক ইবনে হায়সান ফাতেমিনের দরবার অলংকৃত করে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চাকে শীর্ষ শিখরে উন্নীত করেন। ইবনে হায়সান 'কিতাবুল মানাজির' নামে একটি বিখ্যাত চক্ষুবিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন
স্থাপত্য, চারু ও কারুশিল্প: অগাধ ধন-সম্পদের অধিকারী হওয়ায় ফাতেনিরা আল আজহার ছাড়াও অসংখ্য সৌধ, প্রাসাদ, মনজিন, মিনার প্রভৃতি স্থাপন করেন। এগুলোর মধ্যে আল আকসার, আল সালেহ এবং ইবনে রাজ্জাকের মসজিদ অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। প্রাত বলিফা আল মুইজ নির্মিত কায়রোর কদর-ইলাহার এবং কদর-উল-মুইজি প্রসাদের নাম উল্লেখ করা যায়। এছার স্থাপত্য শিল্পীদের নির্মিত কায়রের বাব-আল-নসরু বাব-আল-ফুতুহ ও বার আল-জুবায়দা নামক তিনটি বিরাট তোরণ ফাতেনি স্থাপত্যের সর্বাপেক্ষা স্থায়ী নিদর্শনরূপে বিবেচিত হয়। পি. কে হিস্ট্রি এগুলোতে ফাতেনি স্থাপত্যের শিল্পসৌন্দর্যের উজ্জ্বলতম নিদর্শন বলে আখ্যায়িত করেছেন। চারু ও কারুশিল্পেও ফাতেমিরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। হাতির দাঁতের ওপর কারুশিক্ত এবং নৃৎশিল্পের দৃষ্টান্ত বিভিন্ন জাদুঘরে বিদ্যমান। ফাতেমি যুগের দু’জন বিখ্যাত চিত্রকর ছিলেন আল-কাসির ও ইবনে আজিজ। উজির আল আজুরির পৃষ্ঠপোষকতায় এরা চর্চা করেন। চিত্রকলা ছাড়াও ফাতেমি শিল্পীগণ রেশমি কাপড়, বুটি বল ও অন্যান্য কাপড়ের মধ্যে স্বর্ণসূতা ব্যবস্থা করে বিভিন্ন ধরনের বরনকার্য করতে পারতেন।
উপরের আলোচনায় দেখা যায় যে, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং স্থাপত্য ও শিল্পকলা তথা সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিরুদে ফাতেমিদের অবদান অতুলনীয়। সুবুচিবোধসম্পন্ন ও সংস্কৃতিবান হলিফা ও উক্তিবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় ফাতেমি যুগে সভ্যতা ও সংস্কৃতির যে চরম বিকাশ সাধিত হয়, তা পরবর্তীকালে মুসলিম বিশ্ব এমনকি ইউরোপীয় সভ্যতাকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।